কর্নেল গাদ্দাফির পরিচিতি:
পুরো নাম মুয়াম্মার মুহম্মাদ আল গাদ্দাফি(Muammar Muhammad al-Gaddafi)। জন্ম ১৯৪২ সালে সার্ত(surt) নামের এক মরুভূমির প্রান্তে এক বেদুইন তাঁবুতে। মিশুরাতায়(Misurata) এক প্রাইভেট টিউটরের অধীনে সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশুনা শেষ করার পর গাদ্দাফি লিবিয়াতে আর্মি একাডেমিতে যোগদান করেন। এরপর ১৯৬৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর কিছু জুনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের সহায়তায় এক রক্তহীন অভ্যুথ্যানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করেন। সে সময় লিবিয়ার রাজা ইদ্রিস চিকিৎসার জন্য তুরস্কে ছিলেন। তখন গাদ্দাফির বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর।
নিজেকে তিনি জাতীয়তাবাদ ও গনতন্ত্রের এক বিপ্লবী নেতা হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি আরব জাতীয়তাবাদের নেতা গামাল আবদেল নাসেরের অনুসারী ছিলেন।
গাদ্দাফির প্রথম স্ত্রী’র নাম ফাতিহা আল নূরী(Fatiha al Nuri)। বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এ স্ত্রী’র একমাত্র পুত্রের নাম মোহাম্মদ। গাদ্দাফির দ্বিতীয় স্ত্রী’র নাম সাফিয়া (Safia Farkash)। সাফিয়ার ঘরে গাদ্দাফির ছেলেমেয়ের সংখ্যা সাত জন। তারা ‘মিলাদ’ এবং ‘হান্না’ নামের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে শিশু দত্তক নেন। হান্না ১৯৮৬ সালে চার বছর বয়সে ত্রিপোলিতে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় প্রাণ হারায়।
ছেলেমেয়েদের নাম: প্রথম পুত্র: মোহাম্মদ আল-গাদ্দাফি, তিনি লিবিয়ার অলিম্পিক কমিটির প্রধান।
দ্বিতীয় পুত্র : সাইফ আল ইসলাম আল-গাদ্দাফি, তিনি অনর্গল ইংরেজি বলতে পারদর্শী সাইফ লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী। তিনি ২০০৬ এ তার পিতার শাসনামলের সমালোচনা করে দেশ ছাড়েন। কিন্তু আবার তিনি দেশে ফেরেন। তাকে আধুনিক লিবিয়ার মুখ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ২০০৮ এ তিনি ঘোষণা করেন যে, পিতার উত্তরাধিকারী হওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। লিবিয়ার টেলিভিশনে সম্প্রতি বলেছেন, দেশ গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাবে।
তৃতীয় পুত্র : সাদি গাদ্দাফি, সেনাবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মেয়েকে বিয়ে করেছেন তিনি। সাবেক ফুটবলার সাদি ইতালিতে অল্প কিছুদিন চাকরি করেছেন। লিবিয়ার জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার পর তিনি দেশটির ফুটবল ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর বর্তমানে তিনি সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। একশ মিলিয়ন ডলারের একটি সিনেমার ফান্ড সংগ্রহ করেছেন সাদি। তার প্রথম সিনেমাটি হবে একটি জার্মান ছবি ‘দি এক্সপেরিমেন্ট’-এর রিমেক।
চতুর্থ পুত্র : মুতাসিম গাদ্দাফি, মুতাসিম সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল। পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং তিনি দেশে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং সেনাবাহিনীতে তার ইউনিটের প্রধান।
পঞ্চম পুত্র : হান্নিবেল গাদ্দাফি, তিনি জাতীয় সমুদ্র পরিবহন কোম্পানির প্রধান। এই কোম্পানি তেল রপ্তানি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি অনেক সহিংস ঘটনার দায়ে অভিযুক্ত। ২০০৫ এ প্যারিসে বসে গর্ভবর্তী বান্ধবীকে পেটানোর অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ২০০৮ এ জেনেভার একটি হোটেলে দু’জন চাকরকে পেটানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হন হান্নিবেল। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। সেই থেকে লিবিয়া সুইস পণ্য বর্জন করে। তার কূটনীতিককে ডেকে পাঠায়। সব সুইস কোম্পানিকে লিবিয়া ছেড়ে যেতে বলে।
ষষ্ঠ পুত্র: সাইফ আল-আরব, টেফিগ্রাফের এক রিপোর্টে জানা যায়, ২০০৮ এ উচ্ছৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালানোর অভিযোগে জার্মান পুলিশ তার গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে।
সপ্তম পুত্র: খামিস গাদ্দাফি, পুলিশ অফিসার। বেনগাজিতে বিক্ষোভ দমনের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকাররির আকাশে আমেরিকার বিমান হামলার পর গাদ্দাফি আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম একঘরে হন। এই হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২০৭ জন। দীর্ঘদিন পশ্চিমাদের অবরোধে থাকার পর ঐ হামলায় ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হওয়ায় তার উপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। ২০০৯ সালে গাদ্দাফি আফ্রিকান ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন।
নারী সঙ্গ খুব পছন্দ করেন তিনি। সবসময় তাকে ঘিরে থাকে কিছু সেক্সি যুবতি বডিগার্ড। রোমে একবার ৫০০ তরুনীকে তার বক্তব্য শুনার জন্য অর্থপ্রদান করা হয় বলে শোনা যায়।
কর্নেল গাদ্দাফি ও লিবিয়ার বর্তমান পরিস্হিতি!
গাদ্দাফির পতনের দাবীতে কয়েক সপ্তাহজুড়ে লিবিয়ায় চলছে প্রচন্ড গন আন্দোলন। জনগনের সাথে গাদ্দাফির সমর্থক ও বাহিনীর চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। দীর্ঘ ৪২ বছরের গাদ্দাফির স্বৈরশাসনের এখন অবসান চায় লিবিয়বাসী। ধারণা করা হচ্ছে গত কয় দিনে সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
গত ২৫ শে ফেব্রুয়ারি টেলভিশনে দেওয়া এক ভাষণে গাদ্দাফি তার অনুসারীদের অস্ত্রহাতে শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে দেশরক্ষী বাহিনীর জন্য সব অস্ত্রের গোডাউন খুলে দেওয়া হবে। এ বিক্ষোভের জন্য আল কায়দাকে দায়ী করে গাদ্দাফি বলেন, এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে আমাদের ছেলেদের এই কাজে নিয়োগ করেছে আল কায়দা – বিন লাদেন, যার পরিচয় একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে। বিন লাদেন ও তার অনুসারীদের জন্য কোন ক্ষমা নেই। লিবিয়ায় অসন্তোষের জন্য যারা দায়ী, তাদের আটক করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে।
লিবীয় নেতা কর্ণেল গাদ্দাফির ক্রুদ্ধ টিভি ভাষণে দমে যায় নি সেদেশের মানুষ। পূর্ব লিবিয়ার প্রায় পুরোটাই এখন বিদ্রহীদের দখলে। স্থানীয় মানুষের ধারণা সরকার এখন দেশের মাত্র কিছু কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, যার মধ্যে রয়েছে রাজধানী ত্রিপোলির কিছু অংশ, এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় সাবাহ শহর সহ কিছু কিছু এলাকা যেখানে কর্ণেল গাদ্দাফির শক্ত ঘাঁটি রয়েছে।
কর্ণেল গাদ্দাফির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন যে আবদেল ফাতাহ ইউনেস, ক্ষমতার দিক দিয়ে যিনি ছিলেন দুই নম্বরে এবং যিনি একজন নেতৃস্থানীয় জেনারেলও, তিনিও এখন বিরোধীপক্ষে যোগ দিয়েছেন। পূর্বাঞ্চলের বেনগাজিতে রেকর্ড করা এক ভিডিও বার্তায় তিনি তার পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। এছাড়া সেনা কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ গাদ্দাফির পক্ষ ত্যাগ করেছে।
ফরাসী প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে লিবিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সব যোগাযোগ সাময়িকভাবে স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যেখানে মানবাধিকারের ব্যাপক লংঘন হচ্ছে সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকতে পারে না। ফ্রান্সের বড় তেল কোম্পানি টোটাল লিবিয়ায় তাদের তেল উৎপাদনের কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে। আরব লীগ ইতিমধ্যেই লিবিয়ার সহিংস ঘটনাবলীর কঠোর নিন্দা করেছে এবং তাদের নেতারাও একটি বৈঠক করেছেন। লাতিন আমেরিকার দেশ পেরু লিবিয়ার সঙ্গে সবরকম কূটনৈতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফি এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া কর্ণেল গাদ্দাফির পরিবারের সম্পদ জব্দ করা এবং লিবিয়ার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের জন্য বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফিকে অবিলম্বে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেয়া আজকে এক ভাষণে মিসেস ক্লিনটন এ কথা বলেন।
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলির পূবে উপকূলীয় শহর মিসট্রাটায় সরকারবিরোধী এবং কর্নেল গাদ্দাফির অনুসারীদের মধ্যে জোর লড়াই চলছে। ওদিকে বিদ্রোহী শক্তিগুলো বলছে, কর্নেল গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা এখন থেকে সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
এমত অবস্হায় কর্নেল গাদ্দাফি আর বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না। ক্ষমতা ছাড়তেই হবে, কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে লিবিয়াকে ধ্বংসের মুখে রেখে যাবেন গাদ্দাফি।
ওদিকে লিবিয়ায় অবস্হানরত বাংলাদেশী নাগরিকটা দেশ ছাড়তে মরিয়া। লিবিয়ার দারনা শহর থেকে ৪৬২ জন বাংলাদেশীর একটা দল মিশর সীমান্তের কাছে পালিয়ে এসে অবস্হান করছে। কিন্তু তারা নাকি অভিযোগ করেছেন, দূতাবাসের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাচ্ছেন না। সরকার তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা এখনো জানি না।
সাংঘাতিক রকম দাম্ভিক আর বিলাসী এক লোক। শুনেছি তিনি নাকি ৩০ মিলিয়ন ডলারের মালিক। তবে বাংলাদেশ সরকার লিবিয়ার সিমান্তে আটকে পরা বাংলাদেশিদের জন্য কাজ করছেন। মিশর আর তিউনেসিয়া এখন সীমান্ত দিয়ে মানুষদের ঢুকতে দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বাংলাদেশি দেশে এসে পৌছেছেন। লিবিয়ায় কর্মরত প্রায় সাড়ে ৫০০ বাংলাদেশি আজ বুধবার ঢাকায় ফিরছেন। এঁদের মধ্যে ৩৮৩ জন মিসর ও তিউনিসিয়া হয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে দেশে ফিরছেন। এ ছাড়া চীনা কর্তৃপক্ষের খরচে গ্রিসের ক্রিট দ্বীপ থেকে আসছেন ১৪৩ জন। আগামী কয়েক দিনে দেশে ফিরবেন আরও কয়েক শ বাংলাদেশি।