মনিপুর স্কুলের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার অঙ্গিকার(!) ।

১৯শে ডিসেম্বর সকাল ১০টা বেজে ৩০মিনিট। মনিপুর স্কুলের শাখা ক্যাম্পাস রূপনগরের স্কুল মাঠ ছোট ছোট শিশু (যাদের বয়স ৬/৭ হবে) ও তাদের অভিভাবক দ্বারা প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ব নির্ধারিত ভর্তি ফর্মের আবেদনের প্রেক্ষিতে কোমল-মতি শিক্ষার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ হতে যাচ্ছে! কিন্তু তখন ও অপেক্ষার পালা। যদিও কথা ছিল ১০টা নাগাদ অনুষ্ঠান শুরু-হবে, কিন্তু অপেক্ষা করতেই হবে, যতক্ষণ না স্কুলের সভাপতি মাননীয় সাংসদ আলহাজ্ব মজুমদার সাহেব উপস্থিত হচ্ছেন।

 

১০টা ৪৫মিনিটে মজুমদার সাহেব মঞ্চে উপবিষ্ট হলেন। ভাগ্য নির্ধারণই পর্বের উদ্ভব-নি শুরু হল কোরান থেকে নির্যাস কয়েকটি আয়াত দিয়ে, কোরান থেকে ধর্মের শিক্ষক হুজুর সাহেব কিসব আরবি শুনাইলেন বোঝা গেলনা। তবে আমার মত জ্ঞান হীন মূর্খ ছাড়া অনুষ্ঠানের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি-বর্গ এমনকি ভাগ্য নির্ধারণই বাছাই পর্বে আসা কোমল-মতি শিশুরাও যে আরবি খুব ভালো করেই বোঝে(!) তা বুঝতে অসুবিধে হল না। কারণ এত্ত বড় অনুষ্ঠানে কেউ না বুঝলে হুজুর তো আর হুদায় হুদায় আরবি কয়না ।(অবশ্য দেশী সংস্কৃতি প্রেমিক ব্যক্তিত্বরা দেশী সংস্কৃতি বজায় রাখার স্বার্থে দেশীয় কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে বৈদেশিক ভাষা নিষিদ্ধর দাবি তুললে সে দোষ আমার উপর বর্তাবেন না।) হুজুরের কোরান তেলায়ত শেষে অনুষ্ঠান পরিচালনার অনুমোদন দিলেন সভাপতি সাহেব। এবার স্কুলের মাননীয় অধ্যক্ষ মশাই ব্যাখ্যা রাখলেন, কেন আজকের এই ভাগ্য নির্ধারণই পর্ব? তার কথায় দেশে ভালো মানের স্কুলের সংখ্যা হাতে গোনা  কয়েকটি। তার মধ্যে মনিপুর স্কুল অন্যতম। দুঃখের বিষয় এই স্কুলে আসন সংখ্যা মাত্র ১৮০ টি, কিন্তু বিপরীতে ফর্ম জমা পরেছে কয়েক হাজার। তাই সকলকে তো আর ভর্তি করানো সম্ভব না, ঈশ্বরেই নির্ধারণ করবেন কারা এই স্কুলে ভর্তি হতে পারবে, কারা পারবে না। অধ্যক্ষ মশাই এর কথা শেষে মজুমদার সাহেব স্কুলের বিষয়ে কিছু মজুদদারি অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের সামনে হাজির করলেন, এই যেমন ধরুন স্কুলের ফাণ্ডে কত টাকা জমা আছে, কার জন্য কয়টা আসন সংরক্ষিত আছে ইত্যাদি। তিনি আরও যা জানালেন তা সত্যি বিশ্বয়ের! আজকের ভাগ্য নির্ধারণ পর্বে যারা বিজয়ী হতে পারবে না তারা ইচ্ছা করলে তাদের সন্তানদের নিয়ে মনিপুর স্কুলের আরও একটি শাখা ক্যাম্পাস ইব্রাহীম-পুরে ভর্তি করাতে পারবেন। আপনারা আসলে আমরা ভর্তির ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করব। মনিপুর স্কুলের দুটি কম্পাসে যখন লটারির মাধ্যমে ভর্তি করার ব্যবস্থা তখন অন্য ক্যাম্পাসটি লটারির আওতার বাইরে কেন? ইব্রাহীম-পুরের ক্যাম্পাসটিতে কি শিক্ষার মান নিয়ে আপস করেন (!), নাকি ভর্তি বাণিজ্যে দুর্নীতি করার রাস্তা খোলা রেখেছেন? (অবশ্য অনেক আগেই মাননীয় মজুমদার সাহেবের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্যে দুর্নীতির অভিযোগের বুড়ো আঙ্গুল অনেকই প্রদর্শন করেছে) মজুমদার সাহেব আরও জানালেন “সরকার” লটারির মাধ্যমে ভর্তি করার নির্দেশ দিয়েছ। মজুমদার সাহেব “সরকার” যখন লটারির মাধ্যমে ভর্তির নির্দেশ দিলেন তাহলে কি এও নির্দেশ দিয়েছেন লটারির পাশাপাশি ভর্তি বাণিজ্যে দুর্নীতির ব্যবস্থা রাখার(!)?

 

যাহোক বেশি কথা বাড়াবো না, মুল লটারি পর্ব যখন শুরু তখন সময় ১১টা ৩০মিনিট, মজুমদার সাহেব নিজ হাতে লটারির বাক্স ঘুরিয়ে দিয়ে একটি ছোট ছেলের মাধ্যমে লটারির কাগজ টানলেন এবং সেই সাথে ভর্তি ইচ্ছুক কোমল-মতি সোনামণিদের ভাগ্যর চাকাও ঘুরতে শুরু করলো । প্রথম বিজয়ীর রোল নাম্বার ঘোষণা করা হল। একরাশ করতালি পড়লো সাথে সাথে । স্কীনে প্রোজেক্টরের আলো ফেলে লটারিতে বিজয়ীদের রোল নাম্বার দেখার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তাই সোনামণি-রাসহ তাদের অভিভাবকদের দৃষ্টি ঐ প্রোজেক্টরের স্কীনে । সোনামণিরা গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রোজেক্টরের স্কীনে তাকিয়ে আছে, কখন তাদের রোল নাম্বার স্কীনে দেখানো হবে সেই অপেক্ষায়। পর্দায় একে একে ভেসে আসছে বিজয়ীদের রোলনম্বর। আমার পাশের ছিটে বসে থাকা একটি মে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, আম্মু আমার রোল নাম্বার তো স্কীনে দেখানো হচ্ছে না? মায়ের ছোট্ট উত্তর আল্লাহ্‌ কে ডাক(!)। একে একে ১৮০ জন শিশুর রোল নাম্বার পর্দায় দেখানো হল এবং সেই সাথে ১৮০ জন শিশুর জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। পাশে বসে থাকা শিশুটি পুনরায় মাকে জিজ্ঞেস করল আমি এই স্কুলে পড়তে পারবো না? উত্তরঃ আল্লাহ্‌ এই স্কুলে পড়া লেখা তোর ভাগ্যে রাখেনি। ততোক্ষণে সোনামণির চোখে পানি ছল ছল করছে । মাইকে অধ্যক্ষ মশায়ের ঘোষণা আসলো “ প্রিয় অভিভাবকবৃন্দ আপনাদের নিকট আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আজকে ষে শিশু গুলো মনিপুর স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেলো তাদেরকে আমরা বিজ্ঞানমনস্ক ভাবে গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। আপনারা পূর্ণ সহযোগিতা করবেন আশা রাখি ।” বাঃ! খুবিই চমৎকার! অধ্যক্ষ মশাই, আপনি  নির্লজ্জ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুধু মাত্র অভিভাবকদেরই বলৎকার করেননি, একই সাথে বলৎকার করেছেন আপনার স্কুলে সুযোগ পাওয়া, না পাওয়া সকল শিক্ষার্থীদের সাথে । ভাগ্যের লেখন কে করবে খণ্ডন (!) এই কথাটি সোনামণিদের হৃদয়ে রোপণ করে দিয়ে আজ আপনি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন । জানিনা শিশুমন সম্পর্কে আপনার মনস্তাত্ত্বিক কোন ধারনা আছে কিনা? যদি থাকত তবে হয়ত শিশুদের নিয়ে বর্বর রসিকতায় মেতে উঠতেন না। কারণ শিশুমনে যে বীজ রোপিত হয় তা উৎপাটন করা বরই কঠিন।

 

আজ আপনাদের মত ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই মানুষ তার ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দিয়ে ঈশ্বরকে দোষ দিচ্ছে। একবেলা না খেতে পেলে তার নিজ কর্মফল কিংবা বাবা মায়ের কর্মফলকে দোষারোপ করছে । যে শিশুটি আজ আপনার স্কুলে থাকার কথা ছিল তার অবস্থান আজ আপনার স্কুলের পাশের ডাস্টবিনে । ডাস্টবিনে ময়লা কুড়িয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হচ্ছে। শিশু গুলোর এটাই কি ভাগ্য লেখা ছিল? মনে হয় আপনি চোখে রঙ্গিন চশমা লাগিয়ে ঘড়ের বাইরে চলা ফেরা করেন তাই সবকিছু রঙ্গিন দেখেন। এ জন্যেই আপনার স্কুলের পাশের ডাস্টবিনে পড়ে থাকা শিশুটিকে পর্যন্ত দেখতে পান না। সকল শিশুকে ভর্তির ব্যবস্থা নাই বা করতে পারেন, তাকে জীবনে চলতে গেলে এই কর্দমাক্ত সমাজের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হবে, অন্তত এই শিক্ষা টুকু-তো দিতে পারেন। তাই বলে ভাগ্যর অলৌকিকত্বকে মেনে নেবার মত কুশিক্ষা আপনারা দিতে পারেন না। নাকি আপনি সব জেনে বুঝেই নিজেকে সত্যিই বিজ্ঞান মনস্ক অধ্যক্ষ বলে ভাবেন? যদি তাই ভাবেন তা হলে হুজুরের নিকট আজ্ঞা, আমরা যারা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হতে চাই তাদের জন্যে অন্তত একটা কোচিং খোলার ব্যবস্থা করুন, তাতে আপনার যেমন মহৎ উদ্দেশ্য পূরণ হবে অন্যদিকে ইনকামটাও ভালো জমবে। বন্ধুরা আশা রাখি আমরা যারা বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তি বাদী হতে চাই, তারা অন্তত আমার সাথে মহাশয়ের বিজ্ঞানমনস্ক কোচিং এ যোগ দিবেন।

1 thought on “মনিপুর স্কুলের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার অঙ্গিকার(!) ।”

Leave a Comment