খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্ব ভিত্তিক ছড়া।আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত।
উঠতে বসতে, বিবাহে,যাপনে,ফসলে, বুননে, হাসিতে ,আড্ডায়, দুঃখে কষ্টে, এক কথায় বাঙালি জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে শিক্ষণীয়, নিন্দনীয়, বিদ্রুপ কটাক্ষ বা নির্দোষ মজা করার যে শ্লোকগুলো এখনো ভেসে বেড়ায় গ্রামবাংলার লৌকিক জনপদে মুখে মুখে, এগুলোর রচয়িতার নাম কেউ না জানলেও এতে ছন্দের চমৎকারিত্ব, বুদ্ধির ঝিলিক আর জীবনঘনিষ্ট শব্দের আশ্চর্য শক্তিমত্তায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।অথবা ষোল চাষে মুলা/ তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান (খনার বচন)। আমাদেরই পূর্বপুরুষদের এই সৃষ্টিশীল উজ্জ্বলতা গুলো নিজস্ব ক্ষমতাশৈলীর জোরেই স্বমহিমায় টিকে আছে এখনো। শাসন করছে লোকায়ত মনোভূমিকে। এগুলোই বচন, শোলক বা ছড়া নামে সমধিক পরিচিত হয়ে আসছে।
হালকাচালের এই ছড়া গুলোতে সমকালীন লোকজীবনের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যা গুলোকেও লোকায়ত জীবনধারার সাথে মিশিয়ে আশ্চর্য নিপুনতায় প্রকাশ করা হয়েছে। স্বরের স্বতঃস্ফূর্ত গতি দোলার সাথে স্বাভাবিক শ্বাসাঘাতের অনুরণনের মাধমে ছন্দশীল কথাগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই এগিয়ে যায় বলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ছন্দকে প্রাকৃতিক বা লৌকিক ছন্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত লৌকিক কবিদের এই লোকায়ত ধারাটিকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া চলবেনা আমাদের।
খনারবচন সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কৃষক সামজে; যাদের কোনো লিখিত ভাষা নেই।মুখেমুখে প্রচলিত এসব ভাষা যুগযুগ ধরে তাদের কৃষিকাজ এবং জীবনাচারে প্রভাবিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে সোজা চোখে না দেখলেও খনার বচন তার অবশ্যম্ভাব্যতা থেকে কক্ষচ্যুত হয়নি।বরং গ্রামের কৃষকরা বিজ্ঞানের ভাষার চেয়ে প্রবাদ-প্রবচনে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
খনার বচন মূলত চারভাগে বিভক্ত।
* কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার।
* কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান।
* আবহাওয়া জ্ঞান।
* শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ।
লোকমুখে খনা
তাকে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনী। প্রচলিত গল্পে খনা ছিলেন লঙ্কাদ্বীপের রাজকুমারী। মতান্তরে রাক্ষসকবলিত কোনো এক রাজ্যের অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমারীর নাম ছিল লীলাবতী যিনি পরে খনা নামে পরিচিত হন।
আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কথা, উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী তথা উজ্জয়নের রাজা হর্ষ-বিক্রমাদিত্যের রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহির । বরাহমিহিরের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে তিনি পুত্রের কোষ্ঠি বিচার করে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান। হিসেব করে দেখেন মাত্র এক বছরের মধ্যেই মারা যাবে তার প্রিয় শিশুপুত্র।পিতা হয়ে পুত্রের মৃত্যু অসহায়ের মত অবলোকন করতে হবে আর ভয়ংকর দিনগুলি গণনা করে যেতে হবে, এই চিন্তা সহ্য করতে না পরে তিনি ভাসিয়ে দেন পুত্রকে, পাত্রে ভরে নদীর স্রোতে।
অনেকদূরের একরাজ্যে, নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে রাক্ষস সম্প্রদায়। কিন্তু মারা যায় না শিশু, বড় হতে থাকে রাক্ষসদের মধ্যে। ষোল বছর বয়সে শাণিত বুদ্ধির এক রাক্ষস মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে, বিয়ে করে তাকে। মেয়েটি তার জ্যোতির্জ্ঞান প্রয়োগ করে জানতে পারে তার স্বামী মিহির উজ্জয়নের বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র। একদিন দুজন মিলে রওয়ানা দেয় উজ্জয়নের পথে।
পুত্র-পুত্রবধুর পরিচয় পেয়ে রাজপ্রাসাদে তাদের গ্রহণ করেন বরাহমিহির। কথিতআছে, জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের ফলে খনা প্রায়ই রাজসভাতে আমন্ত্রিত হতেন।কৃষিকাজে মেয়েটির ছিল অগাধ জ্ঞান আর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমৎকার পূর্বাভাস দিতে পারত সে। উজ্জয়নের কৃষকরা ব্যাপক উপকার লাভ করে তার কাছ থেকে, আর তা দেখে রাজা বিক্রমাদিত্য মেয়েটিকে তার রাজ্যের দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন।
ফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ শ্বশুর বরাহমিহির ছেলে মিহিরকে লীলাবতীর জিহ্বা কাটার নির্দেশ দেন। বাবার নির্দেশে মিহির খনার জিহ্বা কর্তন করেন। তবে গল্পমতে কথিত রাজকন্যা স্বামীর কাছে অনুরোধ করেন যে, জিহ্বা কর্তনের আগে কিছু বলতে চান। স্বামী অনুমতি দেন। এসময় খনা আবাদ, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, যাত্রা, গবাদি, শস্যাদি, ফলাদি, গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত বচন দেন যা পরে খনার বচন নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়।
হরপিদ দত্তের “দ্রাবিড় গ্রাম” উপন্যাস থেকে নেয়া কিছু অংশ।
“দূর গাঁ থেকে আজ যারা এসেছে তাদের সমস্যা ধানচাষ নয়৷ পান-সুপারী, তাল, খেজুর গাছের ফল না ধরা বা ঝরে পড়ার সমস্যা৷ খনাবিবি একজনকে কাছে ডেকে বলে,
‘শোন রে বাপু চাষার পো
সুপারী বাগে মান্দার রো৷
মান্দার পাতা পচলে গোড়ায়
ফড়ফড়াইয়া ফল বাড়ায়৷’
লোকটির সঙ্গী প্রতিবাদ করে জানায়, ‘অহন দ্যাশে আসছে লবণের দানার লাহান সাদা সাদা সার৷ সেই সার গাছের গোড়ায় দিলে মান্দার গাছের পচা পাতার চাইতে ও গুয়া বেশি ফলে৷’
খনা বিবির দু’চোখ বড়বড় হয়ে ওঠে৷ মাথার ধবধবে পাকাচুলে আংগুল চালিয়ে আড়ষ্ট প্রায় জিহ্বাটা নাচাতে নাচাতে বলে,
‘যেনা শোনে খনার বচন
সংসারে তার চির পচন৷'”
তেলা মাথায় ঢালো তেল,
শুকনো মাথায় ভাঙ্গ বেল।
কপালে নাই ঘি,
ঠকঠকালে হবে কি!
পুত্র ভাগ্যে যশ
কন্যা ভাগ্যে লক্ষী
উঠান ভরা লাউ শশা
ঘরে তার লক্ষীর দশা
যদি না হয় আগনে বৃষ্টি
তবে না হয় কাঁঠালের সৃষ্টি
Shantomon bhaijan,
The post has taken my mind to my root i.e., village of Bangladesh. Alas! How my world has changed in past some decades.
Many many thanks for the post.