১১ বছরের চঞ্চল একটা মেয়ে, নাম পঞ্চমী।
৪ঠা জানুয়ারি, মঙ্গলবার। দুপুর থেকেই পঞ্চমীর পেট ব্যথা করছিল, রাত বাড়ার সাথে সাথে তা বাড়তে থাকে সেই সাথে পেট ফুলা শুরু হয়। পঞ্চমী ব্যথায় কাতরাতে থাকে।
বাড়িতে ছিলেন পঞ্চমীর মা, দাদা-দাদী আর ৫ বছরের ছোট ভাই। বাপ ঢাকায় চাকরি করেন। দাদা বছর দুই আগে হজ্জ্ব করে এসেছেন। এখন হাজী পোদ্দার নামে পরিচিত। বড় আরও তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
মেয়ের অবস্হা দেখে মা-ও কান্নাকাটি শুরু করেন, আশেপাশের বাড়ি থেকে মানুষজন জড়ো হয়। দাদি পাশে বসে কুরআন শরীফ পড়তে থাকেন। দাদা মসজিদ থেকে ইমাম সাহেবকে ডাকায়ে আনেন, হুজুর ঝাড়া-ফুক দিতে থাকেন।
রাত বাড়ার সাথে সাথে মেয়েটির অবস্হা আরও খারাপ হয়, পেট ফুলে বলের মতো হয়ে যায়। আশেপাশের মানুষজন কেউ কেউ শহরে ডাক্তারের কাছে নিতে বলে। দাদা রাজি হয় না, ‘হাসপাতালোত নেওয়া লাগবি নে, তোমরা আল্লা আল্লা কর ঠিক হয়ে যাবি। বাতাস লাগছে তাই পেট ফাপছে, হুজুরে তো কলো শুনলু না! হায়াত- মৌত, বালা- মসিবত সব আল্লার হাতে। আল্লা অসুখ দিছে আল্লাই ঠিক করে দিবি, অসুখ-বিসুখ দিয়ে আল্লা ঈমান পরীক্ষা করে, ধৈর্য পরীক্ষা করে। তোমরা আল্লা বিল্লা করো।’
সকালেও পঞ্চমীর অবস্হা ভাল হলো না। ব্যথার যন্ত্রনায় মেয়েটার কান্নাকাটি আর কান্নাও এখন বন্ধ, মুখ দিয়ে মাঝে মাঝে একটু আওয়াজ বের হয় এখন সকাল নয়টার দিকে মেয়ের অবস্হার আরও অবনতি দেখে মায়ের পীড়াপীড়িতে দাদা গ্রামের একজন ডাক্তার ডেকে আনেন। ডাক্তার সাহের ম্যাট্রিক পাশ, থানায় এক ঔষধের দোকানে চাকরি করতো, পরে নিজেই গ্রামে দোকান দিয়ে চিকিৎসা চালাচ্ছেন, এই গ্রামে উনিই একমাত্র ডাক্তার। ডাক্তার সাহেব মেয়ের চিকিৎসা শুরু করলেন, একটা কড়া ব্যথার ট্যাবলেট সাথে এসিডের ঔষধ খাইয়ে দিলেন। কোন লাভ হলো না, পঞ্চমীর অবস্হা আরও খারাপের দিকে।
মা আর প্রতিবেশিদের অনুরোধে দাদা শেষপর্যন্ত হসপিটালে নিতে রাজি হলেন, “ডাক্তারের কাচে লিয়ে কিচু হবি নে গো মা। আল্লা চাইলেই সুস্হ হবি, দোয়ায়ে শেফা পড়, আল্লাক ডাক, দরুদ পড়, নফল নামাজ পড়।”
থানার সরকারি হসপিটালে যখন মেয়েটিকে নিয়ে আসা হলো তখন বাজে ১২টা। হসপিটালে ঘন্টাখানিক রাখার পর কোন সুরহা না করতে পেরে ডাক্তাররা তাকে শহরের হসপিটালে নিতে বললেন, তখন প্রায় দুপুর ১.৩০। মেয়েটিকে মেডিকেল কলেজ হাসপিটালে নিয়ে আসা হয় দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই পঞ্চমী মারা যায়। ডাক্তাররা তার চিকিৎসা শুরু করেছিল, পেট অপারেশনের জন্য অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
পরে যা শুনেছি, মেয়েটির এ্যাপেন্ডিক্স ফেঁটে গিয়েছিল। ডাক্তাররা বলেছেন, সময়মত অপারেশন করাতে পারলে পঞ্চমী বাঁচতো, সকালেও যদি হসপিটালে নিয়ে আসা হতো তাহলেও বাঁচানো যেত। সময়মত চিকিৎসার অভাবেই শুধু মেয়েটি মারা গেল।
দেখতে গিয়েছিলাম গ্রামে, দাদাকে খুব বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘আপনারাই মেয়েটিকে মেরে ফেললেন’। তাকে আর বলা হয়নি, প্রতিবেশদেরকে বলেছি।
আল্লা আর তার কুরানের দোয়া মেয়েটিকে বাঁচাতে পারেনি, কোনদিনও কাওকে বাঁচাতে পারেও না বরং অতিরিক্ত আল্লা ভক্তি আর নির্ভরতার কারনেই অসংখ্য মানুষকে মেয়েটির মতো সময়মতো চিকিৎসার অভাবে প্রাণ দিতে হয়। ছোটবেলায় দেখা আমার ফুফুও মারা গিয়েছিল বাচ্চা হওয়ার সময়, মনে হয় সে সময় যদি উনিও হসপিটালে থাকতেন তাহলে হয়তো মরতে হতো না, তার বাচ্চাটাকেও এতিম হতে হতো না।
বিষয়টা নিয়া অনেকে তর্ক করেন, সবাই সাপোর্ট করেন সময়মতো চিকিৎসা করানো ভাল, অসুখ হলে চিকিৎসা করানো নবীজিও সাপোর্ট করে গেছেন, তবে জন্ম-মৃত্যু আল্লার হাতে, মেয়েটির এভাবেই মৃত্যু লেখা ছিল, হসপিটালে সময় মতো নিলেও একই সময় মরতো।
আপনাগো পেয়ারা নবী কেমনে চিকিৎসা করাতো তা আমরা ভালো করেই জানি! তার প্রথম পছন্দ ছিল দোয়া দরুদের মাধ্যমে ঝাড়-ফুক, সাথে মধু সহ আরও কিছু কবিরাজি চিকিৎসা। মানলাম তার সময় উন্নত চিকিৎসা ছিল না, কিন্তু এ উন্নত চিকিৎসার যুগেও কিছু ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ এখনও প্রথমেই সেই দোয়াদরুদ আর তাবিজ-কবজের উপরেই নির্ভর করে কেন!! প্রথমেই কেন চিকিৎসার দারস্হ হয় না!! একটাই কারন অতিরিক্ত বিশ্বাস- আল্লাই পয়দা করেন আবার সময় হলে নিয়া যান। এমনও দেখছি, এক বৃদ্ধ মৃতুপ্রায়, তাকে যদি হসপিটালে চিকিৎসা করানো হয়, তাহলে হয়তো কয়দিন হলেও বেশি বাঁচতো কিন্তু ‘যেদিন আজরাইল আসবে সেদিনই মৃত্যু হবে’ এই বিশ্বাসের কারণে হসপিটালের উপর তাদের আস্হা কম। মরে তো যাবেই, হসপিটালে মরার চাইতে নাকি বাড়িতে মরাই ভাল, তেনারা দোয়াদরুদ পড়তে পারেন, মরার সময় আত্মার কষ্ট কম হয়।
চিন্তা করি যদি ধর্মে উল্লেখ থাকতো জন্ম মৃত্যু কোনটাই আল্লার হাতে না, তাহলে হয়তো মানুষের প্রথমেই ডাক্তার আর হসপিটালের কথাই মাথায় আসতো, অসুস্হ মানুষকে বাঁচানোর একমাত্র রাস্তা হিসেবে চিকিৎসাকেই বেছে নিত, দোয়া দরুদ, তাবিজ কবজের উপর নির্ভরতা কমতো। এভাবে অকালে প্রাণ দিতে হতো না অনেক মানুষকে।
এটা আমার গ্রামের বাড়ির ঘটনা। মেয়েটার কথা কিছুতেই মাথা থেকে দুর করতে পারছি না, ঐ দাদাকে ধরে গাতাইতে মন চায়।
Kisu bisoye dimot ase vai. Ekhon mob e. Pore alochona kormu.